জেলা পরিচিতি
জেলার পটভূমি
হাওর জঙ্গল মইষের শিং, এই তিনে ময়মনসিং’ প্রবাদ-প্রবচনে এভাবেই পরিচয় করানো হতো এক সময় ভারতবর্ষের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহকে। ভারতবর্ষের সেই বৃহত্তম জেলা সময়ের বিবর্তনে ছয় জেলায় রূপান্তরিত হলেও জেলা সদরের গুরুত্ব তুলনামূলক বিচারে কমে যায়নি। বাংলাদেশের মানচিত্রে যে জেলাটি আজ ময়মনসিংহ জেলা হিসাবে চিহ্নিত তা বাংলাদেশের মধ্য-উত্তরাঞ্চলের ২৪০০২’৩১” থেকে ২৫০২৫’৫৬” উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯০৩৯’০০” থেকে ৯১০১৫’৩৫” পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র বিধৌত বাংলাদেশের এই উর্বর ভূমি শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য ও লোক-সংস্কৃতির এক বিপুল আধার।
ময়মনসিংহের ইতিহাস অতিশয় সমৃদ্ধ। উত্তরে গারো পাহাড়, দক্ষিনে ভাওয়াল মধুপুরের বনাঞ্চল, পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎসারিত মেঘনার জল বেষ্টনী এবং পূর্বে সোমেশ্বরী তিতাস, সুরমা ও মেঘনা নদীর অববাহিকা অঞ্চল, প্রাকৃতিক প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলকে বরাবরই একটি দুর্জেয় অঞ্চল হিসেবে দেখতে পাওয়া যেত। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ একমত পোষণ করেন যে, বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলা নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন বংগরাজ্য। গোড়ার দিকে ময়মনসিংহ জেলার মধুপুর গড়সহ লালমাটির অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন বংগরাজ্য। হিন্দু রাজাগণের মৌর্য শাসন এর প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী সময় গুপ্ত ও পাল শাসকদের ইতিহাস ময়মনসিংহকে ঘিরে রেখেছে। শেষের দিকে সেন বংশীয় রাজাদের প্রশাসনিক দৌর্বল্যে মুসলমান বাদশাহগণ বাংলায় রাজত্ব কায়েমের প্রভাব ময়মনসিংহেও পড়ে। সিকান্দর শাহ-এর আমল থেকে মোঘল সাম্রাজ্য পেরিয়ে নবাবী আমল, কোম্পানী আমল এবং শেষে পাকিস্তানি শাসন-শোষণে ময়মনসিংহও প্রভাবান্বিত হয়। বিভিন্ন সূত্রে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৩৯টি পরগনার নাম পাওয়া যায়- ময়মনসিংহ, আলাপসিংহ, জাফরশাহী, বনভাওয়াল, পুথুরিয়া, কাগমারী, আন্টীয়া, বড় বাজু, সেরপুর, হাজবাদি, খালিয়াজুরী, জয়নশাহী, কুড়ি খাই, নছরৎশাহী, লতিফপুর, মকিমাবাদ, আটগাও, বলরামপুর, বরিকান্দি, বাউ খন্দ, চন্দ্রপ্রতাপ, ঈদগা, ইছকাবাদ, বায় দোম, সিংধা দরজিবাজ, কাসেমপুর, নিক্লী, সাসরদি, হাউলী, জকুজিয়াল, ইছাপুর, বরদাখতি, পাতিলা দহ, তুলন্দর, ইছপসাহী, হোসেন শাহী, হোসেনপুর, সুসঙ্গ ও নাসিরুর্জিয়াল।
জেলার নাম ময়মনসিংহ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। আর ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। সলিম যুগের উৎস হিসেবে নাসিরাবাদ, নামটিও আজও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও উল্লেখ করা হচ্ছে না। ১৭৭৯-তে প্রকাশিত রেনেল এর ম্যাপে মোমেসিং নামটি বর্তমান ’ময়মনসিংহ’ অঞ্চলকেই নির্দেশ করে। তার আগে আইন-ই-আকবরীতে ‘মিহমানশাহী’ এবং ‘মনমনিসিংহ’ সরকার বাজুহার পরগনা হিসাবে লিখিত আছে; যা বর্তমান ময়মনসিংহকেই ধরা যায়। এসব বিবেচনায় বলা যায় সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালের পূর্ব থেকেই ময়মনসিংহ নামটি প্রচলিত ছিলো। জেলা পত্তন কালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জমিদারগণ সরকারের কাছে জেলার নাম ময়মনসিংহ রাখার আবেদন করলে সরকার তা গ্রহণ করে নেন।
ময়মনসিংহ নামের বিস্তীর্ণ এ জনপদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্রের লীলাভূমি। এককালে ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ জেলা হিসেবে খ্যাত ময়মনসিংহ পরবর্তীতে প্রশাসনিক প্রয়োজনে বেশ কিছুটা ছোট হয়ে আসে। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইল জেলা পৃথক জেলার স্বীকৃতি পাবার পরও ময়মনসিংহ ছিল পাক-ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। ময়মনসিংহের ভূ-প্রকৃতিতে একদিকে নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ জলাভূমি-হাওর অঞ্চল, মধুপুর ও ভাওয়ালের বিশাল বনাঞ্চল, ময়মনসিংহ-জামালপুরের সমতল অঞ্চল, শেরপুর-ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চল, টাঙ্গাইলের বিস্তীর্ণ বিলাঞ্চল সহ উর্বর ভূমি- এ জনপদকে দিয়েছে বৈচিত্রের সমাহার। ভূ-প্রকৃতির বৈচিত্রের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক জীবন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, জীবিকা এবং সংস্কৃতি বৈচিত্রপূর্ণ। টাঙ্গাইলের পর পর্যায়ক্রমে জামালপুর (শেরপুরসহ), কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা পৃথক জেলার মর্যাদা পাবার পরও আয়তনের দিক থেকে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলা বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অন্যতম। এ জেলার উর্বর ভূমি ধান, পাট, সবজি ও রবিশস্য উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী।
জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জেলাকে দিয়েছে শিক্ষা নগরীর মর্যাদা। দেশের একমাত্র মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, ন্যাশনাল একাডেমী ফর প্রাইমারী এডুকেশন, প্রথম গার্লস ক্যাডেট কলেজ এবং কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এ জেলায় অবস্থিত। এশিয়ার বৃহত্তম- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ সদরে স্থাপিত। যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসেন। আণবিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহ সদরেই স্থাপিত। ময়মনসিংহ দেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর অন্যতম। এখানে অসংখ্য প্রাচীন স্থাপত্য, পুকুর-দীঘি রয়েছে। জেলা সদরের বুক চিড়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। বৃটিশ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন, পাগলপন্থী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, টংক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ৬৯-এর গণ আন্দোলন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ গণতান্ত্রিক প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে এ অঞ্চলের সাহসী মানুষের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার স্বীকৃতি রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে জলছত্র-মধুপুর, ভালুকা, ফাতেমা নগর (কালির বাজার)-এর প্রতিরোধ যুদ্ধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ তেলিখালির যুদ্ধ এবং ধানুয়া কামালপুরের যুদ্ধও।
দীর্ঘকালের হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম শাসনের ঐতিহ্য ময়মনসিংহকে সাংস্কৃতিকভাবে ধনাঢ্য করে গেছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ঐতিহ্যে লালিত হয়ে আসছে এই ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক বন্ধন। যেসব ব্যক্তিত্ব ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তাঁরা হলেন এখানকার জমিদারবর্গ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক আবুল কালাম শামছুদ্দিন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রমুখ। বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোক সংস্কৃতিও রূপান্তরিত হয়েছে ঐতিহ্যে। ময়মনসিংহ গীতিকা বিশ্ব দরবারে অলংকৃত করেছে ময়মনসিংহের নিজস্ব পরিচয়। স্বপ্নের নকশী কাঁথায় বোনা হয়েছে এখানকার বাস্তবচিত্রের কাহিনী। মহুয়া মলুয়া থেকে জয়নুল আবেদীনের চিত্র হয়ে উঠেছে বিশ্বময় ময়মনসিংহের গৌরব গাঁথা। ঈশাখাঁর যুদ্ধ বা সখিনা-সোনাভানের কাহিনী বাতাসে ছড়ায় বীরত্বের হৃদয় ছোঁয়া বিরলপ্রভা।
——————————x————————————–
ভৌগলিক পরিচিতি
অবস্থান ও আয়তন
ময়মনসিংহ একটি অন্যতম পুরাতন জেলা। এর উত্তরে ভারতের মেঘালয়, পূর্বে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে গাজীপুর জেলা এবং পশ্চিমে টাঙ্গাইল, জামালপুর ও শেরপুর জেলা অবস্থিত। এ জেলাটি প্রায় ২৪°১৫’ ও ২৫°১২’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০°১৩’ ও ৯০°৪৯’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। নদীপথসহ এর মোট আয়তন ৪,৩৬,৩৪৮ হেক্টর বা ৪৩৬৩.৪৮ বর্গ কিলোমিটার এবং দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২.৯৬% দখল করে আছে। আয়তনের দিক থেকে এ জেলা দেশের ৫ম এবং ঢাকা বিভাগের মধ্যে ১ম। জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে আয়তনের দিক থেকে ফুলপুর বৃহত্তম (৫৮,০২১ হেক্টর) এবং ধোবাউড়া ক্ষুদ্রতম (২৫,১০৫ হেক্টর)।
কৃষি জলবায়ু
এ জেলায় সাধারণত হাল্কা শীত ও গরম অনুভূত হয়। এপ্রিল ও জানুয়ারিতে মাসিক গড় সর্বোচ্চ প্রায় ২৪° ও গড় সর্বনিম্ন ১২.৬° তাপমাত্রা থাকে। গ্রীস্মকাল এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে জুন এবং শীতকাল ডিসেম্বরে শুরু হয়ে মার্চ মাসের আগমণে শেষ হয়। বৃষ্টিপাত মে মাসে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরে শেষ হয়। শতকরা ৯৫ ভাগ বৃষ্টিপাত মৌসুমী সময়েই হয়ে থাকে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালের বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত যথাক্রমে ১৮১৯ ও ১৬৫৭ মিমি। আপেক্ষিক আর্দ্রতার গড় সর্বোচ্চ ৯০% (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এবং গড় সর্বনিম্ন ৭১% (জানুয়ারি-এপ্রিল) বজা
য় থাকে।
মাটির ধরণ
জেলার উত্তর অংশের সামান্য পার্বত্য এলাকা ব্যতীত এ জেলা পলল ভূমি ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলের অন্তর্গত পাললিক ভুমি। অধিকাংশ মাটির ধরণ হচ্ছে দোআঁশ-এঁটেল দোআঁশ এবং এতে অল্প পরিমাণে জৈব পদার্থ বিদ্যমান। এ জেলার মাটি ৭, ৮, ৯, ২২, ২৮ ও ২৯ এগ্রো ইকোলজিক্যাল জোনভূক্ত (AEZ)।
শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সূতিকাগার বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ১৭৮৭ সালের ১মে জেলা হিসেবে জন্মের পর বর্তমান ময়মনসিংহের আদল পায় ১৯৮৪ সালে। উত্তরে গারো পাহাড় ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে গাজীপুর জেলা, পূর্বে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলা বেষ্টিত ময়মনসিংহ জেলার ভৌগোলিক পরিবেশ বিচিত্র হওয়ায় বলা হয়-‘‘হাওর, জঙ্গল, মইষের শিং-এ নিয়ে ময়মনসিং”। ৪,৭৮৭ বর্গমাইলের রত্নগর্ভা এ জেলার প্রাণবন্ত মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় এর নামের মাঝেই- My-men-sing অর্থাৎ আমার লোকেরা গান গায়। মহুয়া-মলুয়ার দেশ ময়মনসিংহের পূর্ব নাম ছিল নাসিরাবাদ। মোঘল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধকের নামে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী- কালের বিবর্তনে যা ময়মনসিংহ নামে পরিচিতি লাভ করে। ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। এ নদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বহু ছবি এঁকেছিলেন। এখানকার বহু স্থাপনায় প্রাচীন নির্মাণ শৈলীর ছোঁয়া রয়েছে। আছে কালের সাক্ষী স্বরূপ ভগ্ন জমিদার বাড়ী। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে এ জেলার ত্রিশাল উপজেলার সাথে। সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আর বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠির ময়মনসিংহ জেলার এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অবস্থিত সকল বাংলাদেশী নাগরিক ঘরে বসেই জানতে পারবেন জেলা সংক্রান্ত যে কোন তথ্য। সহজে ও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হবে যে কোন দাপ্তরিক কর্ম। কম সময়ে, কম খরচে নাগরিক সেবা সংক্রান্ত যে কোন তথ্য প্রদানের মাধ্যমে জনগণের কষ্ট লাঘব করবে ওয়েবসাইটটি। সর্বোপরি বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই ওয়েবসাইট।